জি কে সাদিক
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর তার নিজস্ব ওয়েবসাইটে বিশ্বের শরণার্থী শিশুদের শিক্ষার হার নিয়ে বেশ কবছর আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ইউএনএইচসিআর যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা আগামী দিনে একটি নিরক্ষরদের বিশ্ব তৈরি করবে। সন্ত্রাস দমন, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অধিকার আদায়ের নামে, জনগণের নাম করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে যুদ্ধগুলো হয়েছে তার ফলে শান্তি যতটা এসেছে, অনেক গুণে বেশি হয়েছে অশান্তি। যুদ্ধ, নির্যাতন, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের কবলে পড়ে পৃথিবী নামক গ্রহটা ক্রমে বিষিয়ে যাচ্ছে। অর্থ ও অস্ত্র শক্তিই এখন টিকে থাকার অবলম্বনে পরিণত হচ্ছে। বিশ্বের অনেক দেশের সাধারণ মানুষের জন্য-‘মারো না হয় মরো’ এটাই এখন শেষ উপায়। যখন এই স্লোগানটা কোনো দল তাদের লক্ষ্য বানিয়ে নেয় তখনই জন্ম হয় ‘সন্ত্রাসী বা জঙ্গি’ দল। এমতাবস্থায় ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদনটি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
ইউএনএইচসিআর কর্তৃক প্রকাশিত ‘নাটকীয় পরিবর্তন : সংকটে শরণার্থী শিক্ষা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ও নির্যাতনের ফলে ২০১৭ সালের শেষে ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়েছে। এর মধ্যে ১ কোটি ৯৯ লাখ শরাণার্থী ইউএনএইচসিআর-এর তালিকাভুক্ত। তবে এই তালিকায় ফিলিস্তিনের ৫০ লাখ শরণার্থী যোগ করা হয়নি। তালিকাভুক্ত প্রায় দুই কোটি শরণার্থীর মধ্যে ৫২ শতাংশ শিশু। এদের মধ্যে ৭৪ লাখ শিশু স্কুলে যাওয়ার উপযোগী। সংস্থাটির হিসাবমতে, এর মধ্যে ৪০ লাখ শিশু স্কুলে যাচ্ছে না। আর বাকি যারাও যাচ্ছে তাদের মধ্যেও ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই শিশুরা যত বড় হচ্ছে তাদের মধ্যে ঝরে পড়ার প্রবণতা ততই বাড়ছে। বিশেষ করে পারিবাকি সমস্যা, আর্থিক সংকট, শিক্ষার সুযোগ না থাকা, থাকলেও তা উপযোগী নয় ইত্যাদি কারণে শিশুরা বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ছে। প্রতিবেদনে বিশ্বের সাধারণ শিশুদের সাথে শরণার্থী শিশুদের স্কুলে ভর্তির একটা তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে বলা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের সাধারণ শিশুদের মধ্যে স্কুলে ভর্তির হার ৯২ শতাংশ, সেখানে শরণার্থী শিশুদের মধ্যে এ হার ৬১ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব শরণার্থী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়, তাদের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিশু মাধ্যমিক স্কুলে যেতে পারে না। এই হিসাব মতে, শরণার্থী শিশুদের মাধ্যমিকে ভর্তির হার মাত্র ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ শিশুদের মধ্যে এ হার ৮৪ শতাংশ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই চিত্র আরো হতাশাজনক। যেখানে বিশ্বের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার ৩৭ শতাংশ, সেখানে শরণার্থী শিক্ষার্থীদের ভর্তি হার মাত্র ১ শতাংশ। ইউএনএইচসিআর-এর দাবি, গত তিন বছর যাবৎ এ সংখ্যার কোনো পরিবর্তন নেই। তবে লাগামহীনভাবে দীর্ঘ হচ্ছে শরণার্থীর মিছিল।
বর্তমান সংকটাপন্ন বিশ্বে শরণার্থী শিশুদের শিক্ষার এই দৈন্য বহু-সংকটের একটা ছোট অংশ মাত্র। আগে সংকটের মূল সন্ধান করতে হবে। আর এখানেই আন্তর্জাতিক সংস্থা ও পরাশক্তি দেশগুলো ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। উন্নত দেশগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য যতটা তৎপর, যদি তার কিঞ্চিৎ পরিমাণ সতর্ক হতো শরণার্থী সমস্যা কেন সৃষ্টি হচ্ছে এ বিষয়ে, তাহলে এমন মানবিক বিপর্যয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না। ইউরোপিয়ান ও আমেরিকার দেশগুলো শরণার্থী নিয়ে যে সমস্যায় পরেছে তা তাদের ‘স্বহস্তে’ সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়। ইউরোপের ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো শরণার্থী ঠেকাতে যেভাবে একাট্টা হচ্ছে, যদি তারা শরণার্থী সৃষ্টির কারণ বন্ধে এমন ঐক্য দেখাতে পারত তাহলে শরণার্থী বিড়ম্বনা পোহানোর প্রয়োজন হতো না। এক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ। আবার এটাও বলা যায়, যেহেতু শরণার্থী সংকটের পেছনে তাদের দেশগুলোর আগ্রাসী নীতিই দায়ী, তাই দেশের ওপর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির দায় না চাপিয়ে তারা কেবল নিজেদের বাঁচাতেই বেশি তৎপর। এতে করে যেমন তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের স্বার্থও ঠিক থাকছে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো প্রান্ডি শরণার্থী শিশুদের শিক্ষা ও তাদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘শিক্ষা শুধু শিশুদের ক্ষতিপূরণের সহায়তা করাই নয়, এটা তাদের দেশের পুনর্গঠনের মাধ্যমও বটে। শিক্ষা ছাড়া এসব শিশু ও তাদের সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ তৃতীয়বারের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ গ্রান্ডির কথাগুলো সত্য; তবে গতানুগতিক। গ্রান্ডি শরণার্থী শিশুদের তৃতীয় ক্ষতি পোষানোর জন্য হয়তো পর্যাপ্ত স্কুল করতে বলবেন, শিশুদের শিক্ষা সহায়তা বাড়ানোর প্রস্তাব আসবে, ঝরে পড়া রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ছাড়া আরো যা প্রয়োজন হয় করবেন। কিন্তু এতে কি ক্ষতিপূরণ হবে? সংকট আসলে শিক্ষা নিয়ে নয়। বহুমুখী সংকট দেখা দিয়েছে। আর শিক্ষা দিয়েই কি একটা শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চত করা সম্ভব হবে? সম্প্রতি ভেনিজুয়েলায় সৃষ্ট আর্থিক সংকটে পড়ে যারা দেশ ত্যাগ করছে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত। ভেনিজুয়েলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়নি। যেমনটা হয়েছে সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ফিলিস্তিন, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানে। যেমনটা উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও রয়েছে।
কার্যত এখানে সংকটের পেছনে দায়ী সে দেশের শাসন ব্যবস্থা। ফলে সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক সমস্যা। তাই এ সংকট বন্ধ করতে হবে। একইভাবে উত্তর কোরিয়ার কথা বলা যায়। যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে না, তথাপি শিশুদের শিক্ষা ও পুষ্টির সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এর কারণ ক্রমাগত নিষেধাজ্ঞা। উত্তর কোরিয়ার জনগণ ‘সাক্ষী গোপাল’। তারপরও তাদেরই শাস্তি পেতে হচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অর্থ সমস্যা নয়। এখানে যুদ্ধের ফলে শিশু মারা যাচ্ছে, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, খাদ্য, চিকিৎসাসহ অন্যান্য মানবিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক জাতিগত নিধন, নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণ, সম্পত্তি লুটের ফলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর ঢল নামে। বিগত বছরগুরোতে এর কোনো সমাধান হয়নি। সমাধানের সম্ভবনাও ক্ষীণ।
উল্লিখিত সংকটগুলোর ভিন্ন ভিন্ন কারণ ও রূপ বিদ্যমান। তাই এখানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠন ও পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোকে একত্রিত হয়ে সমস্যার স্বরূপ উপলব্ধি করতে হবে ও সমাধান কল্পে যথাযোথ উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে এ সমস্যা দূর হবে না। বরং রাষ্ট্রবিহীন শিক্ষিত নাগরিক সৃষ্টি করা হবে। যাদের থাকবে না অন্য সবার মতো মানবিক ও মৌলিক অধিকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এর পরে আসে শিক্ষা। শিশুদের জন্য নিরাপদ বাসস্থান তাদের নিজ দেশেই করতে হবে এবং শিক্ষার ব্যবস্থাও। অন্য দেশে শরণার্থী হিসেবে নয়।
সম্প্রতি জাতিসংঘ ইয়েমেনে যুদ্ধাপরাধ ও মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। কিন্তু সৌদি ও মিয়ানমার উভয়েই তাদের উপর আনিত অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রত্যাখ্যান করার পেছনে ইন্ধন দিচ্ছে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো। যেসব দেশে শরণার্থী সৃষ্টি হয়েছে সবক্ষেত্রেই পরাশক্তিগুলোর সরাসরি ইন্ধন রয়েছে। আর এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর অক্ষমতা ও ব্যর্থতা দেখা গেছে। তাই শরণার্থীদের অধিকার নিশ্চিত বা সহায়তা নিয়ে মাথা খাটানোর চাইতে বেশি প্রয়োজন শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির কারণগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক